পুরাতন গ্রামীণ জমিদারী হওয়া চলে যাচ্ছে,সে জায়গা দখল করে নিচ্ছে একটি শিল্পপতির দল ।
এই সামাজিক সত্য তারাশঙ্কর ফুটিয়ে তার লিখাতে বার বার,শরতের পর বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসিক তারাশঙ্কর এই নিয়ে কোন দ্বিধা নেই,তারাশঙ্করের শ্রেষ্ঠ দুইটি উপন্যাস হল "হাসুলি বাকের উপকথা" এবং "কবি" ।
কবি উপন্যাসের নায়ক একজন কবি । তবে কবি বলতে আমরা সাধারনত যা বুঝি সেই কবি তিনি নন,উপন্যাসের নায়ক নিতাইচরন একজন কবিয়াল । কবিয়ালরা মুখে মুখে কবিতা তৈরি করত এবং তা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করত গ্রামীণ বিভিন্ন উতসবে,প্রচন্ড রকমের ট্যালেন্ট না থাকলে যে কারও পক্ষে কবিয়াল হওয়া সম্ভব নয়,এটা বুঝা যায় । নিতায়চরনের কবিয়াল হওয়াটা একটা ইতিহাস । লেখক বলেনঃ
"শুধু দস্তুরময় বিস্ময়কর ঘটনায় নয়,রিতীমত এক সংঘটন । চোর ডাকাত বংশের ছেলে হতাৎ কবি । "
নিতাইয়ের জন্ম হিন্দু ডোম বংশে, সে ডাকাত বংশের লোক । তারা প্রাচীনকালের লাঠিয়াল । তাদের উপাধি হল বীরবংশী । নিতাইয়ের মামা গৌর বীরংশী এই অঞ্চলের বিখ্যাত ডাকাত । নিতাইয়ের মাতামহ গৌরের বাপ শংকু বীরংশী আন্দামানের কারাগারে মারা যান । নিতাইয়ের বাপ সিধেল চোর । তাই নিতাই হল খুনীর দৌহিত্র, ডাকাতের ভাগিনে, ঠ্যাঙ্গাড়ের পৌত্র, সিধেল চোরের পুত্র, নিতাইয়ের চেহারাতে বংশের ছাপ স্পস্ট এবং প্রতক্ষ । দেহ কঠিন পেশী দীর্ঘ সবল, রঙ কাল, শুধু চোখের দৃষ্ট বড় বিনীত । একবার এক মেলাতে এক বিখ্যাত কবিয়াল না থাকাতে নিতাইকে মঞ্চে তুলে দেয়া হয়, তারপরে নিতাই তার প্রতিদ্বন্দ্বী কবিয়ালকে প্রায় ঘায়েল করে ফেলে শেষে তার প্রতিপক্ষ কবিয়াল নিতাইয়ের পরিবার নিয়ে অশ্লীল আক্রমণ করে কবিয়াল লড়াইয়ে জিতে যায়, কিন্তু ওই মঞ্চেই নিতাই জয় করে নেয় হাজারো মানুষের মন । নিতাইয়ের লেখা পড়ার ইতিহাসও বেশ চমকপ্রদ,খাবার এবং কাপড়ের বিনিময়ে সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হলে নিতাই তাতে যোগ দেই এবং লিখাপড়ার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয় । নিতাই এর মা তাকে চুরি করতে বললে বাড়ি ছাড়ে নিতাই । রেল ইস্টিশনে কুলিগিরি আরম্ভ করে, সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র রাজা । রাজা অসম্ভব খোলা মেলা ফুরতিবাজ মানুষ, গ্রামের ইস্টিশনেই সে কাজ করে, নিতাইয়ের সাথে রাজার বন্ধুত্ত থাকাতে নিতাই অনেক অনেক বেশি আয় করে অন্য কুলিদের থেকে, একটা কথা না বললেই নয় যা উপন্যাসের অনেক যায়গাতেই এসেছে রাজা বউ পেটাতে অসম্ভব ভালোবাসে । নিতাইয়ের কবি গুন প্রকাশিত হওয়ার পরে সবার দৃষ্টি ভঙ্গিমায় পরিবর্তন আসে, একজন তো ব্যাঙ্গ করে বলেই ফেলে
you are a poet,A POET ।
(আমি হুমায়ুন তোরাব ব্লগে লিখালিখি করে বলে আমার আব্বু আমাকে বলে "তুই ইন্টারনেটে কবি গিরি করস ??")
রাজার শালিকা হল ঠাকুরঝি । এই উপন্যাসের অন্যতম নায়িকা । পাশের গ্রামের বধূ সে, গরুর দুধ বিক্রি করে সে, এই জন্যেই প্রতিদিন তাকে এই গ্রামে আসতে হয় । এই ভাবেই নিতাই এর সাথে তার পরিচয়,নিতাই এর মনের মানুষ সে ।
লেখক বলেন "ঠাকুরঝির কথাও যেমন দ্রুত,চলে সে তেমনি ক্ষিপ্র গতিতে,ঢ্যাঙা নয়,অথচ সরস কাঁচা বাশের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোতে বেশ একটি চোখজুড়ানো লম্বা তান আছে,এই দীঘল ভঙ্গীটি নিতাইয়ের সবচেয়ে ভাললাগে ।"
একদিন রাজা ঠাকুরঝির গায়ের রঙ কাল হওয়ার কারনে তাকে উপহাস করে,কবি নিতাইয়ের মনের মাঝে তা ধাক্কা লাগে,ঠাকুরঝির মন খারাপ হওয়াতে নিতাই কবিতা লেখে ।
"কাল যদি মন্দ তবে চুল পাকিলে কেনে কাঁদ ??
কালো কেশে রাঙ্গা কুশুম হেরেছ কি নয়নে ।"
(হুমায়ুন আহমেদের বিভিন্ন লিখাতে এই লাইন পড়ে থাকবেন ।)
নিতাই তার জন্যে গানও লিখে ফেলে,
"ও আমার মনের মানুষগো
তোমার লাগি পথের ধারে বাধলাম ঘর ।
ছটায় ছটায় ঝিকিমিকি তোমার ইশারায়,
আমার হেথা টানে নিরন্তন ।
ও আমার মনের মানুষগো"
কিন্তু থাকুরঝি যেহেতু আরেকজনের বউ,এই কথাটি মাথাতে এলে মনের কষ্টে গান বাধে নিতাই ।
"চাঁদ দেখে কলঙ্ক হবে বলে কে দেখে না চাঁদ
তার চেয়ে চোখ যাওয়াই ভাল ঘুচুক আমার দেখার স্বাদ
.....................................................................................................................
চাঁদ তুমি আকাশেতেই থাক,আমি তোমায় দেখব খালি
ছুতে তোয়ামায় চাই নাক হে,
সোনার অঙ্গে লাগবে কালি "
এই অবস্থায় উপন্যাসের টারনিং পয়েন্ট হিসেবে আগমন ঘটে উপন্যাসের আরেক নায়িকার । ঝুমুর দলের সদস্য সে ।ঝুমুর দলের লোকেরা সাধারনত যাত্রা গান করে এবং মেয়েরা টাকার বিনিময়ে দেহ ব্যবসা করে । এই দলের সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে বসন এর সাথে নিতাইকে দেখে ফেল্লে,অভিমান করে ঠাকুরঝি এবং এক পর্যায়ে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘতে এবং বারবার নিতাইয়ের নাম বলতে থাকলে নিতাইকে সবাই দোষারপ করা শুরু করে ।মনের দুঃখে ঝুমুর দলে জগ দেয়ার জন্যে পা বাড়ায় নিতাই । নিতাইয়ের সাথে বসনের ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়,ঝুমুর দলের কবিয়াল হিসেবে নিতাইয়ের নাম যোশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । উপন্যাসের এই অংশে অসম্ভব সুন্দর কবিতা লিখে ফেলে নিতাই ।বসনের সাথে নিতাইয়ের এর সুখী জীবনের সমাপ্তি ঘটে বসনের মৃত্যুর মাধ্যমে । নিতাই বসন্তকে নিয়ে কবিতা লিখে
"এই খেদ মোর মনে মনে,
ভালবেসে মিটল না আস,কুলালো না এ জীবনে
হায় ! জীবন এত ছোট কেনে !
এই ভুবনে ?? "
বসন মারা যাওয়ার পড়ে কাশি চলে যায় নিতাই,সেখানেও তার মন বসে না,তাই সে আবার ফিরে আসে তার গ্রামে । নিতাই তখন বড় কবিয়াল,তার ট্রেন যখন স্টেশনে থামে তখন সে দেখে তার আসার খবর শুনে গ্রামের সকলে ভিড় করেছে স্টেশনে,রাজার সাথে বহু বছর পর দেখা হয় তার,এবং তার সাথে কখপকথনের মাধ্যমে শেষ হয় উপন্যাসের ।
বই থেকে
"নিতাই আসিয়া বসিল সেই কৃষ্ণ চুড়া গাছের তলায় । রাজাকে দাকিয়া পাশে বসাইল ।লাইন যেখানে বাকিয়াছে,দুই লাইন যেখানে একটি বিন্দুতে মিশিয়া এক হয়েছে,সেখানে দৃষ্টি নিবন্ধন করিয়া নিতায় বলিল
-রাজন ! ভাই
-ওস্তাদ !ভেইয়া !
-ঠাকুরঝি ?
-ওস্তাদ
-রাজন
-ঠাকুরঝি তো নাই ভেইয়া ।
-নাই,রাজন !
-নাই,উত মর গেয়ি ।
রাজার মত শক্ত মানুষের ঠোঁট দুইটিও কাপিতে লাগিলো,বলিল
-ঠাকুরঝি খেপে গিয়েছিল অস্তাদ,তোমার যাবার পরে ।
....................................................................................................................................................................................................................
নিতাই উঠিল,বলিল
-চল
- কোথায় ??
-চন্ডিতলায়,চল মাকে প্রনাম করে আসি ।
....................................................................................................................................................................................................................
মায়ের দরবারে মাকে গিয়া শুধায়বো
-জীবন এত ছোট কেনে এই ভুবনে ??
মুখবন্ধ - অসাধারন একটা বই,অসাধারন সব কবিতা,না পড়লে এখনি পড়ে ফেলুন ।