গল্প

জন্ম মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ

Jan 31, 2013

এম্বুলেন্স যেন চলতেই চাচ্ছে না । একটু এগুতেই আবার থেমে যাচ্ছে । ঢাকা শহরের মানুষজনও প্রচন্ড স্বার্থপর হয়ে গেছে । যে এম্বুলেন্সে একটা রোগী জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তাঁকে যেতে দিচ্ছে না , ঢাকা শহরের পাথরের দালানে থেকে মানুষগুলোর হৃদয়ও বুঝি আজ পাথর হয়ে গেছে । আমার স্ত্রী নিশি আজ বিকাল থেকে কেঁদেই চলেছে , আমার শ্বাশুড়ীর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে । তাঁর কান্নার আওয়াজ যেন বুক চিরে ভিতরে গিয়ে লাগছে । আমার বোন মুন্নি অনবরত আমার পাশে বসে কাঁপছে । আমি নির্বাক চোখে হেলান দিয়ে বসে আছি , নিথর ...

গাড়ি থেমে আছে ঢাকার জ্যাম এ । এম্বুলেন্সে হাসপাতালের লোকজন গুলোর চোখে মুখে যেন বিষাদের ছায়া । এম্বুলেন্স শব্দ করেই যাচ্ছে কিন্তু জ্যাম ছাড়ছে না । আর সহ্য করতে না পেরে দৌঁড়িয়ে দৌঁড়িয়ে গেলাম ট্রাফিক এর কাছে , মুখে কিছু বলতে পারলাম না । তাঁর সামনে বসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলাম , হয়তো সে বুঝলো তাই তার স্যার এর নির্দেশ না মেনে , আমাদের গাড়িগুলোকে ছেড়ে দিলেন ... এম্বুলেন্স আবারো চলছে । আমার সামনে আমার ২ বছর বয়সী সন্তান ইমরান শুয়ে আছে । মুখে মাস্ক লাগিয়ে শুয়ে আছে । তাঁর নিথর দেহকে জাগিয়ে তোলার জন্য এম্বুলেন্স এর লোকজন অনবরত চেষ্টা করছে ।

রাস্তায় চলার সময় যে এম্বুলেন্স এর শব্দ আমার বিরক্ত লাগতো , মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে বের হতো অশ্রাব্য শব্দ , আজ সেই এম্বুলেন্সে বসে আছি ... আমার সামনে শুয়ে থাকা আমার শরীরের অঙ্গ আমার সন্তান সময়ের সাথে সে যেন আরও বেশি শীতল হয়ে পড়ছে । নিশি আর কাঁদছে না , হয়তো চোখের পানি শেষ হয়ে গেছে । তাকে তার মা চেপে ধরে রেখেছে , যেমনটি নিশি আমাদের ইমরানকে ধরে রাখতো । অবশেষে আল্লাহর অসীম দয়াতে ২ ঘন্টা পরে সন্ধ্যায় হাসপাতালে পৌঁছালাম । হাসপাতালের লোকজন ইমরানকে ইমারজেন্সি তে নিয়ে গেল ।আমি নিশিকে ছেড়ে দূরে গিয়ে চেয়ারে বসলাম । দেখতে দেখতে আমার আত্মীয় স্বজন সবাই হাজির হলো ধীরে ধীরে । কতো তাড়াতাড়িই না ২ বছর পার হয়ে গেল । মনে হয় এইতো সেই দিনের কথা , কাজ ছেড়ে বাড়ি ফিরছিলাম ক্লান্ত হয়ে , রাতের ভাত খেয়ে ঘরে ঢুকতেই নিশি বলল ...

- তোমাকে একটা কথা বলার আছে ।

- বলো

কথাটি বলেই হাতের কাঁচের গ্লাসে পানিতে চুমুক দিলাম ...

- আমাকে আর একা থাকতে হবে না , আমার একসঙ্গী আসছে ।



আমার হাতে থাকা কাঁচের গ্লাসটা পড়ে গেছিলো , আমি অবাক হয়ে নিশির দিকে তাকাতেই নিশির মুখে দুষ্টু হাসি খেলে গেছিলো আনন্দে ...

আজ এই দঃখের সময় সেই ঘটনাটি মনে পড়ে ঠোঁটের মাঝে একটু হাসির ঝিলিক ফুটে উঠলো ... বংশের প্রথম আসছে শুনেই আমার বাবা-মা গ্রাম থেকে আসে । আমার ছোটবেলার দোলনাটা ঠিক করে আনতে ভুলেনি আমার বাবা । আমার সন্তানকে নাকি এখানে দুলতে হবে । আমার আর নিশির চাইতে মনে হয় আমার বাবা-মা , শ্বশুর-শ্বাশুড়ির পাগলামো ছিল বেশি । তাই আমি আর নিশি তাই বাঁধা দেয়নি । কাজ শেষ করে ছুটে ফিরতাম বাসায় , কোন কাজ এই মন বসতো না কারন আমার মন থাকতো নিশির গর্ভের ভিতরে , সেই ইমরান আজ হাসপাতালে , মৃত্যুর সাথে লড়ছে ।ইমারজেন্সি থেকে ডাক্তার বের হয়ে জরুরী ভিত্তিতে রক্ত নিয়ে আসতে বললেন । আমি , আমার ছোট ভাই , আমার শ্যালক ছুটলাম ঢাকার পথে । সেই ১৮ বছর থেকে আমি রক্ত দেই , আজ পর্যন্ত কতো ব্যাগ রক্ত দিছি তার হিসাব নেই ...আমি এক পুরানো ব্লাড ব্যাংকের একজন পুরাতন মেম্বার , কিন্তু আল্লাহর ইশারা বোঝা বড় দায় ,ওই ব্লাড ব্যাংকে রক্ত পেলাম না ... তারপর একে একে সব ব্লাড ব্যাংক এ খোঁজ নিতে থাকলাম , একঘন্টা পর ধানমন্ডিতে রক্তের খোঁজ পেলাম । তিনজন বাইক এ ধানমন্ডির স্বনামধন্য এক ব্লাড ব্যাংক থেকে প্রতি ব্যাগ ৫০০০ টাকা দিয়ে ৩ ব্যাগ রক্ত নিলাম ।যে রক্ত আমরা ফ্রি তে দান করি তাতে তাদের ব্যাবসা দেখে হাসলাম। ডাক্তার এর হাতে ব্লাড ব্যাগ দিয়ে বসলাম চেয়ারে । ইমরান আবার ভাল হয়ে উঠবে । কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে আমার বুকে লাফিয়ে পড়বে । আমার দাঁড়ি ধরে টানবে , আমায় চিমটি দিয়ে আব্বু আব্বু বলে ডাকবে ... বুকের মাঝে তাকে রেখে জড়িয়ে ধরে চাপ দিবো । পুরনো স্মৃতিগুলো নিয়ে ভাবতেই মুখে হাসি ফুটলো ...সকালের দিকে ইমারানের কেবিনে ডাক্তার বাড়তে থাকলো , সকাল ১০ টার সময় ডাক্তার কি বললো আমি শুনতে পেলাম না , তবে দেখলাম নিশি মেঝেতে পড়ে গেল,আমার ছোট ভাই হাতু গেড়ে বসে পড়ল মেঝেতে .....



৪ মাস পর ।

টিভি দেখছি , হাতে সিগারেট , আগে সিগারেট খেলে নিশি বকতো এখন আর কিছু বলেনা । খবর দেখছিলাম , খবরের নিচে হেডলাইন পড়লাম ...
" রক্তে ভেজাল মেশানোর জন্য ধানমন্ডির স্বনামধন্য ব্লাড ব্যাংক এর মালিক সহ তিনজন আটক " ।


***** তালাশ এ রক্তে ভেজাল হিসেবে স্যালাইন মিশানোর নিউজ এ অনুপ্রাণিত হয়ে .......

Powered by Froala Editor