গল্প

দর্পণ

Feb 12, 2014

তখন মাত্র সন্ধা মিলিয়ে আকাশের লাল রঙ মিলিয়েছে কালো অন্ধকারে। বাহিরে হালকা ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। আড়মোড়া ভেঙ্গে রাতের মানুষগুলি তখন শহরের রাস্তায় । বনানীর সবুজ গাছপালার মাঝে তখন ভুতুড়ে অন্ধকার। শেহজাদ ২৭ নাম্বার বাসে বসে বসে ঘামছে । বাসের গ্লাসগুলো বন্ধ থাকায় ঝাপসা গরম আকড়ে ধরেছে তাকে । উত্তরার কর্পোরেট অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রতিদিন অনেক রাত হয়ে যায় তার । চৈতি এতে খুবই রাগ করে। ঢাকা শহরের রাস্তার জ্যামের কাছে মানুষের আবেগ কিংবা রাগের মুল্য যে অনর্থক, তা চৈতি বোঝে । তবুও অভিমানী রাগ তার যায় না ।

আজ চৈতি একটু বেশিই রেগে আছে । মেয়েকে সাথে নিয়ে মার্কেটে বসে আছে সে । শেহজাদের জন্যে অপেক্ষা করছে । ঈদের শপিং শেহজাদকে ছাড়া করতে চায় না চৈতি। শেহজাদও তাড়াতাড়ি বের হতে চাইলেও জ্যামে পড়ে দেরী হয়ে যায় তার ।

তবে শেহজাদের এই বাস ভ্রমন ভালই লাগে। লোকাল বাসের মানুষেরা নিজের কথাগুলো অনায়াসে বলে ফেলতে পারে এই সময়ে । এই লোকাল বাসগুলোতে উচু-নিচু কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই যাত্রী । এ যেন অচেনা পথিক হয়ে গন্তব্যে ছুটে চলা । যে যার মনের কথাগুলো তাই বিনা দ্বিধায় বলতে পারে এখানে । নেই বাধা-ধরা কোন নিয়ম। এখানে সবাই মানুষ । খেটে খাওয়া মানুষ ।নির্যাতিত মানুষ ।

শেহজাদের স্মার্ট ফোনের ওয়াল পেপারে চৈতি, মেয়ে বর্ণা এবং শেহজাদের ছবি ঝুলছে। চৈতিকে দেখে হাসি পায় শেহজাদের। এইতো, ক'দিন আগেই পরিচয় হল তাদের।ফ্যান্টাসি কিংডম তখন মাত্র চালু হয়েছে। রোলার কোস্টারের প্রথম সিটে বসে ছিল শেহজাদ। চৈতি কোথা থেকে রাগারাগি করে এসে বসে তার পাশে । পরে অবশ্য শুনেছে তার বোন-দুলাভাই এর সাথে ঝগড়া করে এছিল সেদিন । মিনিট দুইয়েকের কোস্টার ভ্রমন শেষে টলতে থাকা চৈতি রোলার কোস্টার থেকে নেমে সেই যে শেহজাদের হাত ধরেছিল, তা এখনো সে ছাড়েনি, আরো গভীর ভাবে বুকের মাঝে চেপে ধরে রেখেছে । মাস দশেক প্রেম করে রাবি হতে পাশ করে চাকরি পেয়েই শাহজাদ বিয়ে করে ঢাবির ছাত্রী চৈতিকে।

শেহজাদের সম্পুর্ন বিপরীত চৈতী। গ্রাম্য ছেলের গ্রাম যেমন খুব প্রিয়, তেমনি গ্রাম একদমই অপছন্দ চৈতীর। YWCA থেকে Dhaka City College হয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রীর শহুরে জীবন ভাল লাগে । বিয়ের পর চা বানানো ছাড়া আর কিছুই পারতো না চৈতী । শেহজাদের মায়ের কাছ থেকে রান্না শিখেছে হাতে কলমে । চৈতির পায়েশ তো শেহজাদের এখন খুবই প্রিয় ।

দেখতে দেখতে তাদের ছোট সংসারে আলো জ্বেলে আসে বর্ণা । কি ফুটফুটে মিষ্টি মেয়ে সে! শেহজাদ যখন প্রথম কোলে নেয়, তখন মাথাটা ছিল কত ছোট । শরীরটা তুলতুলে । মেয়ে যেদিন বাসায় আসে, চৈতী তো অবাক। এক হাজার গোলাপ ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তার ঘরে। শেহজাদের পাগলামী ভাবটা আর যায় না। বৃষ্টি হলেই চৈতিকে নিয়ে নেমে পরত ভিজতে । একবার বৃষ্টিতে ভিজে দুদিন জ্বরে বিছানায় পড়ে থেকে কি বকাটা না খেয়েছিল চৈতির কাছে । তবুও শেহজাদ বৃষ্টিতে ভিজে । এখন তো বর্ণাকে সাথে নিয়ে ভিজে । তিন জন এক সাথে বৃষ্টিতে ভিজে ছাদে । পাগল মানুষের পাগলামী আর কি !!!!!

এসব ভাবতে ভাবতে মার্কেটে এসে পড়ে শেহজাদ । শেহজাদকে দেখে বর্ণা দৌড়ে ছুটে আসে তার কোলে । অভিমানে চৈতীর গাল ফুলে যায় । অনেক কিছু কিনে ফেলে শেহজাদ। চৈতীর শাড়ি, জুতো । মেয়ের জন্য ফ্রক, জুতো, চুলের ক্লিপ। আর শেহজাদের পাঞ্জাবী । ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় তাদের। মার্কেটের হোটেলে হালকা খাবার খেয়ে নেয় তারা । তারপর বাসায় ফেরার সময় শেহজাদের আব্বুর জন্য পাঞ্জাবী, মায়ের জন্য শাড়ি, শ্বশুরের জন্য পাঞ্জাবী এবং সেন্ডেল কিনে বাড়ি ফিরে তারা ।

সকালে ঘুম থেকে কখনোই উঠতে চায় না শেহজাদ । চৈতী জোর করে টেনে তুলে দেয় তাকে । মোহাম্মাদপুর থেকে উত্তরা যেতে খুব বিরক্ত হয় শেহজাদ,চৈতীকে অনেক বার বলেছে উত্তরাতে ফ্লাট নিতে ,কিন্তু চৈতী তার বাবা-মা কে ছেড়ে যেতে চাই না, আবার সে ছুটে ঢাকার রাস্তায় ।
ছাত্র জীবনে সিগারেট খেত শেহজাদ । বিয়ের পর বাসর রাতে চৈতি কড়া ভাবে বলে দেয়,

-ঐ ঠোঁটে সিগারেট খেলে,আমি তোমাকে চুমু খেতে দিব না ।

চৈতির ঠোঁটে চুমু খাওয়ার লোভেই হয়তো শেহজাদ সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেয়। চৈতির জন্য জীবনে অনেক পরিবর্তন আসে শেহজাদের। অগোছালো ভ্যাগাবন্ড শেহজাদ হয়ে ওঠে লক্ষী জামাই। অফিস থেকে ফিরে গোসল না করলে বর্ণাকে ছুতেই দেয় না চৈতি।

এভাবে দিন যায়,আকাশে সূর্য উঠে আবার ডুবে যায় ।

দেখতে দেখতে ঈদ চলে আসে।

নাড়ির টানে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় শেহজাদ, বর্ণা এবং চৈতি। রাজশাহীতে শশুর বাড়িতে দেখা করে নিজ গ্রামে যায় শেহজাদ। রাজশাহী হেতেমখাঁ তে আসতে সন্ধা নামে তাদের। হেতেম খাঁ গোরস্থানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে একটু উঁকি দেয় তারা। নাহ্, কবরটা আর আগের মত নেই, বাঁধানো কবরের রং উঠে গেছে। মাটি এক দিকে ধসে পড়েছে। একটা নিম গাছ মাথা তুলে দাড়িয়েছে। বর্ণাকে কবরের পাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, শেহজাদ অবাক হয়। এখনো সে দর্পনের সামনে দাড়ালে চৈতিকে দেখতে পায়। এক পাশ থেকে শেহজাদকে জড়িয়ে ধরে থাকে সে। কাছে যেতেই বর্ণার কান্না মিশ্রিত আম্মু আম্মু শব্দ আসে।

শেহজাদের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। চশমা খুলে হাতের উল্টা পাশ দিয়ে মুছে ফেলে। দেখতে দেখতে চার নাম্বার ঈদ চৈতিকে ছাড়া চলে আসে, জীবন চলছে।

অন্ধকারে দুই বাপ-বেটিকে কেউ দেখে না। রাতের পেচা গুলো ডানা ঝাপটা দিয়ে জেগে উঠে। হয়তো শেহজাদ-বর্ণার সাথে স্মৃতিতে বেঁচে থাকা চৈতিকে উপর ওয়ালা দেখে। সময় কাটে, রাত ধিরে ধিরে গভীর হয়।

Powered by Froala Editor