গল্প

একটি কালো গোলাপের গল্প ।

Mar 25, 2013

দখিনের ঘিয়া রঙের বাড়িটার ৩ তালা তে গোলাপী রঙের একটা ব্রা ঝুলছে,উঁকি মেরে মাঝে মাঝে তা দেখছে ইমতিয়াজ । লজ্জা লাগছে তার,রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উঁকি মারতে তার বড় লাগে,মাঝে মাঝে একটু ভয়ও হচ্ছে,কেও যদি দেখে ফেলে ?

নাহ,বেঞ্চেই বসল ইমতিয়াজ,ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে বসেছে সে । হাত থেকে কালো গোলাপটা বেঞ্চে রাখলো সে । ধানমন্ডীর সোবহানবাগ এলাকা,একটু হেটে গেলে মিরপুর রোড। গাজিপুর চৌরাস্থা থেকে ২৭ নাম্বার বাসে উঠে ৩ ঘন্টায় এখানে এসেছে সে। আবার একটু উঁকি মারল ইমতিয়াজ। নাহ,বারান্দাতে কেও নেই,একলা গোলাপী রঙের একটা ব্রা বাতাসে দুলছে ।

আজ জুন ম্যাচের ২৬ তারিখ,আজ থেকে ঠিক ৭ বছর আগের কথাগুলো ইমতিয়াজের এখনো চোখের সামনে ভাসে । ঢাকা ভার্সিটির মুজিব হলে তখন ইমতিয়াজ থাকত । এই দিন খুব ভোরে উঠে গিয়েছিল বেইলি রোডে । কালো চুলের মাঝে লাল চুল গুলো মাঝে মাঝে উঁকি ঝুঁকি মারত সুস্মিতার ঘাড়ে ।গাড়ি করে এসে নামত কলেজের সামনে । ভিকারুন্নেসার সামনে তখন মেয়েরা ভরপুর,এর্‌ই মধ্যে সুস্মিতা কে চোখে পরে ইমতিয়াজের,সাহস নিয়ে এগিয়ে যেয়ে লাল রঙের কার্ড সহ একটি কালো গোলাপ তার হাতে তুলে দেয় ইমতিয়াজ ।

- মামা,কেমন আছেন ?
- ভালোই,আপনি ?
- আপনাদের দোয়াই আছি এক রকম । একটা মুদির দোকান দিছি সামনে ।
- তাইলে আপনি এখানে কেন ? ঐ খানে থাকলেই তো পারেন ।
- না,মামা । জীবনভর, চায়ের ব্যবসা করতেছি,তাই এইকাম ছাড়বার মন চাই না,বড়ো পোলারে দোকান চালাইতে দিছি । আর আমি এখানে ।

পানের এক গাদা পিক ফেললো মামা,দুপুর হয়েছে ।
কড়া রোদে পানের পিক তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় ।
ইমতিয়াজের মনে হইলো,এইতো কয় দিন আগেই তো ১০ হাজার জমানো টাকা থেকে সে দিয়েছিল এই মামা কে,আজ দেখতে দেখতে ৬ বছর হয়ে গেল ।

সুস্মিতার সাথে দেখা হওয়া টা গল্প উপন্যাসের মতো । ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে প্রথম বারের মতো টিউশনি পায় ইমতিয়াজ, তার বন্ধু চাচাতো বোনের . ধানমন্ডি এলাকায় বিশাল একটা বাড়ি,বেশ লাগত পড়াতে । মেয়েটাও ছিল বেশ সুন্দর । মাস দুই পড়ানোর পর মা অসুস্থ হয়ে পড়াতে গ্রামে গিয়ে দেড় মাস থাকতে হয় ইমতিয়াজের,তার জায়গাটায় আসে আরেক জন শিক্ষক । বাড়িতে থাকার সময়ই ইমতিয়াজ বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে । ভালোবাসা আবেগময় গান গুলো তার হৃদয় ছুঁয়ে যেত। বাড়ি থেকে ফিরে শুধু তাকিয়ে যাওয়া,সকাল ৭.৩০ টা আর ১.৩০ এ বেইলি রোডে । রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থেকে। টিউশনি হারানোর ৮ মাস পরে প্রপোজ করে ইমতিয়াজ । হাতের লাল কার্ড আর কালো গোলাপটা ব্যাগে রেখে কলেজে ঢুকে সুস্মিতা । তার পর শুধু অপেক্ষা, একটি "হ্যা" সোনার প্রতীক্ষা । অদ্ভুত হলেও সত্য কলেজ ছুটির পর সুস্মিতা কে খুঁজে পাইনি ইমতিয়াজ । সে দিন রাত ১১.৫৬ মিনিটে এ একটা মেসেজ আছে ইমতিয়াজের মোবাইলে

"হয়নি বলা একটি কথা, হয়েছে শুধু উনুভূতি ।"

অতঃপর ২টি মন এক মালাতে গাথা,একটি হাতের সাথে আরেকটি হাতের বাঁধন । শাহবাগের রাস্তায়,নীলক্ষেতের বিরিয়ানীর দোকানে,পরিবাগ,লালবাগের কেল্লা এমন কি উত্তরার ইছাপুরার মেঠো পথে কত হেঁটেছে ।

-মামা চা নেন আরেকটা ?
-দেন,চিনি কম দিয়েন।
-মামা,ডায়বেটিস হয়েছে নাকি ?
-না মামা,এমনি ।

সুস্মিতার সাথে হাটতে হাটতে এই সোবহানবাগে এসে মামার সাথে পরিচয় হয় তাদের । সংসার চলছিল না মামার। মামার জীবনের গল্প শুনে কষ্ট পেয়ে তাই ইমতিয়াজের পকেটে থাকা টাকা বের করে দেয় মামাকে । তারপর থেকে প্রায় আসা হত এখানে ।

-মামা,খুব গরম ভিতরে আসেন।ফ্যান চালিয়ে দেই।
-দোকানটা তো বেশ মামা,চায়ের দোকানে ফ্যান লাগিয়েছো,বাহ।


প্রেমের বয়স ৩ চলার সময় হুট করে একদিন ফোন করে আসতে বলে ইমতিয়াজকে সুস্মিতা । টি এস সি তে গাড়ি থামিয়ে সুস্মিতা বলে-

-গতকাল আমার বিয়ে হয়ে গেছে । আমাকে ক্ষমা করো । আর পারলে আমাকে ভুলে যেও ।
-দুষ্টুমি কর কেন ?? হাসতে হাসতে বলেছিল ইমতিয়াজ।
-তুমি জানো যে আমি তোমাকে মিথ্যে কথা বলিনা ।

তারপর গাড়ি ছুটিয়ে চলে যায় সুস্মিতা,ইমতিয়াজ অসহায় হয়ে চেয়ে থাকে। ওই দিন কী বৃষ্টি হয়েছিল ? আকাশে কোনো রঙের মেঘ ছিল ? কালো না সাদা? বৃষ্টিতে কি বৃষ্টি তে ইমতিয়াজ ভিজে ছিল। আজ আর মনে নাই,অনেক আগের কথা। তবে কাক গুলো খাবার খুজতে ছিলো ডাস্টবিনে,আলো ছায়া জীবনে অনেকবার দেখা থাকলেও সে দিনের ছায়ার রঙ ছিলো সাদা,ধুসর সাদা । সে দিনের মত ঢাকা শহরটা এত বেশি ফাকা কখনো লাগেনি ইমতিয়াজের,কেন জানি দম বন্ধ হয়ে আসছিল তাঁর ।

ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে ইমতিয়াজের । কালো একটা গাড়ি এসে থামে ঘিয়া রঙের বাড়িটির সামনে,ছোট একটা বাচ্চা নামলো সাথে একটা মহিলা । মহিলার লাল চুল গুলি ঘাড় বেয়ে নিচে ঝুলছিলো । আগের চেয়ে বেশ মোটা হয়েছে সুস্মিতা,আরও বেশি সুন্দর,আর মায়াময় । ঘিয়া রঙের বাড়িটায় ঢুকলো তারা। ভালোবাসার জন্যে দ্বিতীয় কাওকে পাইনি সে,ভালোবাসা যে যাকে তাকে বেলাবার জিনিষ নয় । আর ভালোবাসলেই যে তাকে পেতে হবে এমনতো কথাও নেই । সারা দুপুর কথা বলে কাঁটালো মামার সাথে ইমতিয়াজ । সময় বড় তাড়াতাড়ি কেটে যায়,তাই সন্ধ্যা নামলে গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ইমতিয়াজ । যাওয়ার সময় একটু উঁকি মেরে আবার দেখে ইমতিয়াজ বারান্দা টায়,নাহ নেই,গোলাপী রঙের ব্রা টা আর ঝুলানো নে্য।

রাত ৯ টার সময় দরজা খোলে সুস্মিতা,চা মামা একটা বক্স দিয়ে যায়। রুমে ঢুকে বক্সটা খোলা সে,একটি মেমোরি কার্ড এবং একটা মরা কালো গোলাপ আছে সেখানে । কম্পিউটারে মেমোরি কার্ড ঢুকিয়ে দেখলো টানা ৭ ঘন্টার রেকর্ডিং । কানে হেডফোন দিয়ে শুনতে শুনতে সুস্মিতার মনে হলো

"এতো সুন্দর মানুষের গলার আওয়াজ হয় কিভাবে ?? ৪ বছর আগে মানুষটার আওয়াজ যা ছিল আজ ও তেমনি আছে । মানুষটার গলা টা এত ভালো কেন ? জগতের ভালো মানুষ গুলার জীবনে কি এরকম ?? কম্পিউটারে সেভ করলো সে রেকর্ডিংটা,৪ বছরে ৪ টি রেকর্ডিং আর ৪ টি কালো গোলাপ জমা হয়েছে তার । ৪টি গোলাপের পলিথিন গাল বেয়ে আসা অশ্রুতে ভিজে না।

Powered by Froala Editor