গল্প

চৈত্রের শেষ রাত্রি ।

Jun 20, 2013

জীবনের চাকা ঘুরছে ।
রহিম মিয়া প্যাডেল মারছে ।
পড়ন্ত চৈত্রে প্যাডেলের সাথে সাথে জীবনের চাকা সামনের দিকে এগুচ্ছে ।
রাত ৯ টা বাজে রাস্তার ধারের পাশের দোকানে,রহিম মিয়ার রিকশা থেমে আছে গ্রিন রোডে । শাহবাগ থেকে মোহাম্মদপুর যাচ্ছে রহিম মিয়া,সারাদিন রিকশা চালানোর পর তার পা মাঝে মাঝে অবশ হয়ে যাচ্ছিলো । পিছন থেকে সিগেরেট খেতে খেতে এক ছেলে বলল ।

-কি মামা ভাত খান নাই ? হাইটা গেলেও তো আপনার আগে যাইতে পারুম।

রহিম মিয়া আরও জোরে প্যাডেলে পা চালানোর চেষ্টা করল,কিন্তু তার পা মানছে না,বিদ্রোহ করছে তার পা । কিছুটা নিমক হারামিও বটে । তার পা আরাম চাইছে,পায়ের আরাম দরকার । রহিম মিয়া আরাম বুঝে না,তার টাকা দরকার ।
২০ হাজার টাকা ।
প্যাডেল তাকে মারতেই হবে,জীবনের চাকা তাকে ঘুরাতেই হবে ।


রানু বসে আছে মেডিক্যালের বারান্দায় । তার ছেলে তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে । রানুর ছেলে অসুস্থ । তার পেটে অসুখ হয়েছে । ডাক্তার বলেছে ৫০ হাজার টাকা লাগবে । টাকা ছাড়া তার ছেলে বাঁচবেনা । এক সপ্তাহ ধরে মেডিক্যালের বারান্দাতে পড়ে আছে ৩ বছরের বাচ্চা কলিম,রানুর ছেলে । রানুর একমাত্র ছেলে,রানুর বুকের মানিক । রানুর জীবনে বেচে থাকার একমাত্র সম্বল কলিম,রানুর আর সন্তান হবে না । তাই কলিমের বেচে থাকার মাঝেই রানুকে বেচে থাকতে হবে ।

কলিমের পেটের দিকে তাকাতে রানুর ভয় হয় । কলিমের পেট ফুলে বেলুনের মত হয়েছে, কলিম তখনও গুমাচ্ছে । রানুর কোলে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছে । মাঝে মাঝে রানুর গাল বেয়ে থুতনি দিয়ে ফোটায় ফোটায় পানি পড়ছে কলিমের কপালে । কলিম তা জানেনা । কলিমের তা জানার কোথাও না । কলিমের মত তাই রানুও জানেনা । রানুর চোখ তখন ঝাপসা । সামনের ভবিষ্যতের মতই ঝাপসা ।

সাইন্স ল্যাব মোড়ের জ্যামে আটকা পড়েছে রহিম মিয়ার রিকশা । রিকশা রেখে তার পাসে ফুটপাতে বসে আছে রহিম মিয়া । বিড়ির টান তার খুব দরকার । গত এক সপ্তাহে সে একটা সিগারেটও কিনে খাইনি,তার মত রিকশাওয়ালার কাছে থেকে ঠোঁটে ঠোঁটে যতটুক পেয়েছে সে খেয়েছে । তার টাকার দরকার,বৃথা খরচের মত টাকা তার নেই । সকাল ৬ টা থেকে রাত ৯টা অবধি দুই হাজার টাকা ইনকাম করেছে সে । তার আরও ১৮ হাজার টাকা দরকার,সময় খুবই কম,যে কোনো মুহূর্তে থেমে যেতে পারে তার হৃদয়ের স্পন্ডন ।রিকশাতে থাকা ছেলেটা সিগারেট ফেলে দিয়েছে । সিগারেট এখন অর্ধেকে জ্বলছে । বিড়িটা মুখে নিল রহিম মিয়া, রিক্সার পিছনে যেয়ে কালো রং এর বিড়িতে ঠোঁট লাগালো ।


এক সপ্তাহ আগে কলিম চিপ্স খেতে চেয়েছিল । টাকার অভাবে কিনে দিতে পারেনি রানু । এক চড় মেরে টেনে বাসায় আনে তাকে রানু । সে রাতেই পেট ব্যাথা ওঠে কলিমের । পেটের ব্যাথাতে কোঁকাতে থাকে,জুনা খালার তেল মালিশে কাজ না হাওয়াতে ভোর রাতে মেডিক্যালে আসে তারা । তার পর থেকে কলিমের পেট ফুলছে । ডাক্তার বলেছে সময় খুব কম । ডাক্তারের পা ধরে কেঁদেও কিছু করতে পারেনি তারা । ডাক্তারের টাকা চাই,পঞ্চাস হাজার টাকা ।

পুরান ঢাকার বস্তিতে ফিরতে ফিরতে রাত ১২ টা বেজে গেল রহিমের,হাতে ২২০০ টাকা । ২০০ টাকা হাতে রেখে বাকি টাকা রেখে দিল কৌটার ভিতরে,রানু হাসপাতালে রান্না হয়নি কিছুই,চুলায় ভাতের সাথে আলু তুলে দিল রহিম মিয়া,চৈত্র মাসের আজ বধয় ২৯ তারিখ । দিন চলে যাচ্ছে,কিছু বুঝে উঠার আগেই দিন চলে যাচ্ছে । চুলায় রান্না হচ্ছে ।ভাত রান্না হবে,তার পর রহিমের পেট কিছু দানাপানি পড়বে ।তারপর রহিম ঘুমাবে । জীবন থেকে ছুটি নিবে কিছুক্ষনের জন্যে ।

বাহিরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে । রানু তার শাড়ীর আচল দিয়ে কলিমকে ঢেকে রেখেছে । চৈত্রের শেষবেলার বৃষ্টির ঝাঁপটা তবুও মাঝে মাঝে এসে লাগছে , রানুর চোখে তখন ঘুম আসছে, সারাদিন তিন জনের বাসাতে বুয়ার কাজ করে তার শরীর তখন দুর্বল । দুচোখে রাজ্যের ঘুম । সন্ধ্যায় গ্রিন রোডে এক সাহেবের বাসায় অল্প পোলাও খেয়ে তার খুধাও মরে গেছে । বারান্দার দেয়ালে হেলান দিল রানু, বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে । বৃষ্টি তবুও হচ্ছে ।
রহিম মিয়ার পুরান ঢাকার বস্তিতে তখন রাজ্যের গরম,ওখানে বৃষ্টি হয়নি,ক্লান্ত রহিম মিয়ার চোখে তখন ঘুম ।

রহিম মিয়ার মাথার ভিতরে তখন জীবনের চাকা ঘুরছে,রিকশা চলছে,প্যাডেলের উপরে টাকা বাধা,যত প্যাডেল দিচ্ছে তত টাকা সে পাচ্ছে ।
রহিম মিয়া তখন স্বপ্ন দেখছে,জীবনের স্বপ্ন ।জীবনের চাকার স্বপ্ন ।
রহিম মিয়ার ঘুম হয়না,আধো ঘুম আধো জেগে থেকে রাত কাটে তার ।
সকালে গরম ভাত নিয়ে রানুর কাছে গেল রহিম মিয়া,৩২ হাজার টাকা দুইজনে ধার দেনা করে জমিয়েছে । রানুর গায়ের রঙ কাল হলেও সুশ্রী । তেল না দেয়া লম্বা লম্বা চুল গুলো রুক্ষ ।

বেলা ৯টার দিকে রহিম ও রানুকে গা ঠেকিয়ে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখা গেল। মেডিক্যালে তখন মানুষ বাড়ছে । ডাক্তার এলেন ৯ টার পরে ।
কলিম তখন কোকাচ্ছে ।

ডাক্তার সাহেব বললেন
- সময় কম,তাড়াতাড়ি টাকা জোগাড় করুন ।

ধার দেনা এবং জমানো টাকায় ৩২ হাজার হয়েছে ।আরও টাকা কোথা থেকে আসবে ভাবতে লাগল রানু । সামনে রোদ পড়ছে । রোদের আলোতেও রানুর মুখ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে । রানুর কাল মুখ যেন অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে ।


১০ টার পরে কাজে গেল রানু ও রহিম্ মিয়া,কলিমকে একা ফেলে।

রানু গেল ভুতের গলিতে । কাজ শেষ করতে তার দুপুর হয়ে গেল।
তারপর দ্বিতীয় বাড়ি সাইন্স ল্যাব । ধিরে ধিরে এগুতে থাকল রানু সে দিকে ।

পড়ন্ত দুপুরে সাইন্স ল্যাবের ১৮ তলা বিল্ডিং এর ১৩ তলার একটি বাসায় কাজ করতে গেল । এ বাড়ির বড় সাহেবকে তার ভয় করে । একবার তাকে আদর করতে চেয়েছিল সে,রানু রাজি হয়নি । চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে কাওকে মুখ ফুটে বলতেও পারেনি ।বাসায় ঢুকে রানু দেখল বাসা খালি । বড় সাব আছে শুধু । ঘর মুছতে মুছতে হতাত রানু বড় সাহেবের রুমের দিকে এগুলো । আস্তে আস্তে বড় সাহেবের ঘরে ঢুকল রানু । ব্লাউজের উপরের ২টা বোতাম খুলে দিল সে । শাড়ির আচল ফেলে দিয়ে বড় সাহেবের সামনে দাড়ালো রানু ।

এর পর কি হল রানু ঠিক বুঝতে পারলনা । কিছু বুঝে উঠার আগেই তার গায়ে খেলতে থাকল এক জোড়া হাত । রানুর মনে পড়ল রহিমের কথা,তাকে কখনো এভাবে ধরেনি সে । ৫ বছরে এক বারও এভাবে কুকুরে মত খামচি অথবা কামড় দেইনি সে । অনেক কস্টে মুখ ফুটে বলল রানু

-আগে টেকা ,২০ হাজার টেকা ।
-তোরে আমি ২০ হাজার টেকা দিয়ে কিনুম ।
তারপর কি হয়েছিল কেউ জানেনা,জানে শুধু মেডিক্যালের ডাক্তার।
৫০ হাজার টাকা নিয়ে সে অপেরেশন শুরু করে রাত ৮ টাই ।

কয়েক ঘন্টার কুকুরে খাওয়া শরিরে সাবান মাখতে থাকে রানু । কিছু না বললেও ঘন্টা খানেক পর রহিম এসে জড়িয়ে ধরে রানুকে বাথরুমে,
রানু অনেক কষ্টে বলে,
-আমারে মাফ কইরা দিইয়েন ।


তারপর বৃষ্টি নামে ।
চৈত্র মাসের শেষ রাতের বৃষ্টি ।
টিনের চালে ঝমাঝম বৃষ্টি পড়ে ।
সেই বস্তির টিনের ঘরে অসভ্য মানুষ গুলো ভালবাসা প্রকাশ করে অসভ্য ভাবে । সভ্য মানুষ গুলোর বড় বড় দালানে বৃস্টির আওয়াজ পৌছায় না ।
তারা সভ্য ,তারা আমদের সমাজের পরিচালক ।
তাই বৃষ্টি হয় ।
চৈত্রের শেষ রাত্রে বৃষ্টি ঝরে ।
রানু রহিমের বুকে মাথা রেখে অঝরে কাদতে থাকে । রহিম রানুকে বুকে জড়িয়ে ধরে খুজে পায় পরম নিরভরতা ।
এই সব ছোট লোকদের জন্যে বৃষ্টি নামে ।
চৈত্রের শেষ রাত্রে ।

Powered by Froala Editor