জীবন-কথন

জীবনের পাতা থেকে RS-36 (TARC) “ছুটে যাওয়া লাগামহীন বাছুর” ।

May 19, 2014

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রত্যেক ছাত্রকে তাঁর চার বছরের গ্র্যাজুয়েশন জীবনের ৩টি মাস (ব্র্যাকের হিসেবে একটি সেমিস্টার) সাভারে অবস্থিত ব্র্যাকের ক্যাম্পাসে থাকতে হয়। পূর্বে এই জায়গাটিতে শিক্ষকদের ট্রেইনিং দেয়া হলেও বর্তমানে এখানে ছাত্রদের ট্রেইনিং দেয়া হয়। এই তিন মাস সময়কে আগে TARC বলা হলেও বর্তমানে RS বলা হয়ে থাকে । আমার জীবনে টার্কে থাকা সময়কে নিয়েই আজকের RS (TARC) জীবনের পাতা থেকে এর প্রথম পর্ব “ছুটে যাওয়া লাগামহীন বাছুর” ।

বছরের তিনটি সেমিস্টারের যেকোন সময়েই টার্কে আসা গেলেও প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই টার্কে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। এর প্রথম কারণ অবশ্যই বনানীর জগদ্বিখ্যাত ট্র্যাফিক জ্যাম। বাসা থেকে মহাখালীর ক্যাম্পাসে আসতে এই জ্যামের মধ্যে ঘন্টাখানেক আটকে থেকে ঘামতে হয়। আমার বিশাল শরীরকে ঘাম হতে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই মূলত গ্রীষ্মকালে এখানে আসা। আরেকটি অন্যতম কারণ ছিল তিন মাসের এই সেমিস্টারে পড়ালেখার চাপ (এই চাপ মানসিক চাপ, ফিজিক্সের(?) ভাষায় প্রেশার নহে )ঢাকায় থাকলে অত্যাধিক মাত্রায় বেড়ে যেত।

বসন্ত শেষ হওয়ার সাথে সাথে সাভারে আসার জন্যে পরিকল্পনা করতে থাকি। আমার বড় ভাই-বোনদের কাছে থেকে সাভার সম্পর্কে নানান মতামত নিতে থাকি এবং ওভাবেই পরিকল্পনা আগাতে থাকে। এই কাজে আমাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছে আমার কলেজ বন্ধু নাহিয়ান। ব্র্যাকে ভর্তি হওয়ার সময় থেকেই একটা কথা বার বার শুনে এসেছি টার্ক মানেই ফান, আর ফান মানেই মাস্তি। একটা ইংরেজি আর আরেকটা হিন্দি :D। লাভ বাংলা ইউজ ইংলিশের দ্যাশে হিন্দী কেনু :P??

যায় হোক ব্র্যাকে ভর্তি হলে যেই কথাটি বার বার শুনতে হবে তা হল এই টার্ক। এই টার্ক যে কত আনন্দের, কতটা ঝলমলে টকটকে তা বুঝতে পেরেছিলাম টাকা দেওয়ার সময়। বাপের এতগুলি টাকা (বিশাল অংক) যখন জমা দিচ্ছিলাম ব্যাংকে, আমার সামনে যখন মহিলাটি (নারী কর্মসংস্থায়নে ব্র্যাক ) টাকাগুলি গুনে দেখতেছিল তখন কেন জানি মনে হচ্ছে আমাকে বলি(চাচা চৌধুরী সিরিজ) দেয়া হচ্ছে, আমাকে চিত করে শুইয়ে উপরে করাত(ব্লেড না) দিয়ে কাটা হচ্ছে। এই অনুভূতি অবশ্য প্রত্যেক সেমিস্টরে হয় টাকা দেওয়ার সময়। কলেজ লাইফে পড়ালিখা না করে “সামুতে” পড়ে থাকার কুফল।

আমার কাছে বরাবরই এই টার্ক একটি ঝামেলা মনে হয়েছে। এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতেই ফর্ম ফিলাপ করে ফেলি। আমার ডর্ম(হোস্টেল) সিলেক্ট হয় গন্ধরাজ

যেখানেই ভূতের ভয় সেখানেই হুমায়ুন তোরাবের বসবাস হয় । জন্মগতভাবেই আমি একটু ভীতু পোলা। আমার বেতের (কি পিডানি না খাইছি জীবনে) ভয় না থাকলেও ভুতের ভয় মাশাল্লাহ্ ভালই। ডর্মেটরি ঠিক হয়ে যাওয়ার পরে শুনতে থাকি ডর্মে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা। গন্ধরাজ এর পাশে নাকি শ্মশানঘাট, এই ডর্মেটোরি থেকে নাকি মনের দুঃখে কোন এক কালে একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছিল, বয়েজ ডোর্মে মেয়ে ঢুকেছিল কিভাবে, আর আত্মহত্যাই বা করেছিল কিভাবে তা অবশ্য একটা রহস্য। কিউরিয়াস জাতি অবশ্যই এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়। :P

রাসেল ভাই(ভূত এফ এম) এর কাছে যাওয়ার একটা সুযোগ পাওয়া যাবে এই আশায় আমি বেশ খুশি হয়ে যাই। রাসেল ভাই ! ও আমার রাসেল ভাই শুনে শুনে(ইদানিং ফেসবুকে পড়ে পড়ে) আমি ক্লান্ত হলেও রাসেল ভাইকে দেখার ইচ্ছে আছে আমার। আমার সাথে একটা প্যারানর্মাল ঘটনা ঘটবে আর আমি তা সমগ্র জাতির(আবার জাতি :P) সামনে তুলে ধরবো, তা ভাবতেই ভাল লাগতাছে, আহ কি ফিলিংস্‌ !!

তো আমি রাসেল ভাই এর কাছে যাওয়ার জন্যে কাপড়-চোপড়,বাড়ি থেকে রাতে বের হওয়ার জন্যে বাপ-মায়ের কাছে থেকে অনুমতির কথা ভাবা শুরু করতে থাকি :P

দেখতে দেখতে গুনতে গুনতে সময় এগিয়ে আসে। মে ১৬ তারিখে দুপুরের পরে ব্র্যাকের মহাখালি ক্যাম্পাসে উপস্থিত হই আমরা সর্বমোট ৪৪৭ জন শিক্ষার্থী। মেয়ে ১৮৭ জন, বাকিরা সবাই ছেলে। আমাদের CSE ডিপার্টমেন্ট থেকে সর্বাধিক ১২০ ছাত্র এসেছে এই বারে। এতদিনের নেত্রীত্ব দেওয়া BBS ডিপার্টমেন্ট অনেক বছর পরে তাদের কর্তিত্ব হারায়। অবশ্য এইখানে কে কোন ডিপার্টমেন্ট, এইটা কোন বিষয় না, এইটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়ও না।

দীর্ঘ একঘণ্টারও বেশী লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে বাসে উঠার সুযোগ পাই আমি। আমার চেনা মোটামুটি সব বন্ধুরা মিলে বাসের শতকরা ৭০% যায়গা দখল করে ফেলি, বাকিদেরও বন্ধু বানাতে সময় লাগে নি একদমই। বাস যখন এয়ারপোর্ট রোড হয়ে আশুলিয়া যাচ্ছিল তখন রাস্তা দিয়ে আমার স্কুল দেখতে দেখতে ভাবছিলাম এই জায়গাটি আমাকে দীর্ঘ তিন মাস মিস করতে হবে।

মোটামুটি ঘন্টাখানেকের বাস ভ্রমণের মাধ্যমে চলে আসি সাভার ক্যাম্পাসে। ব্র্যাকের সাভার ক্যাম্পাসের একদম এক কোণায় আমার ডোর্ম (হোস্টেল)। তৃতীয় তলার আমার রুমটা দেখেই খুব ভাল মানের শান্তি পাই আমি। সুন্দর একটা রুম। নতুন বিল্ডিংয়ের জন্যে সব কিছুই নতুন এবং চকচকে। সবচেয়ে মজার(ইন্টেরেস্টিং) বিষয় হল আমার ডোর্মের সামনে মেয়েদের একটা ডোর্ম । খালি জানালা দিয়ে উঁকি দেয়াটাই বাকি, এহেম এহেম ।

এখন তো সময় একটা বাইনু কুলারের.।.।.।.।.।.।.। :D

ট্রাউজার পরে নিচে নেমেই দেখি পোলাপাইন ক্রিকেট ফুটবলে লাত্থালাত্থি শুরু করছে। আমার সাথে আমার বন্ধু রেদোয়ান, খেলা দেখে বলে “বেক্কল পোলাপাইন সারাজীবন ক্রিকেট ফুটবলই খেলব, অন্য কিছু তো সারা জীবনেও খেলতে পারবে না।”

সন্ধ্যায় মাঠে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছিলাম। আমি কিছু বুঝে উঠার আগে শালার রেদোয়ান হঠাৎ বলে বসে “এর নাম তোরাব আলি, এই কিন্তু লেখক, সেই মাপের ব্লগার, অনেকদিন ব্লগিং করে।” আমি মাথা তুলে দেখি একটা মেয়ে (), তখন রেদোয়ান পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তার বাসহপাঠীর সাথে :D । মেয়েটা তার ভামা(ভালোবাসার মানুষ) কে খুঁজতে হাজির হয় এইখানে       :((   :(( । আমি কিছু বলে উঠার আগেই মেয়েটা আমাকে বলে বসে “তুমি কি শাহবাগে আন্দোলনে গেছিলা??” আমি তো চিপায়, কি উত্তর দিমু ??

বয় ফ্রেন্ড থাকুক আর নাই থাকুক হাজার হইলেও তো একটা মেয়ে মানুষ ?? আর কে না জানে মেয়ে মানেই আকর্ষন,না যায় ছাড়া না যায় ধরা ।

তো আমার স্বভাব সুলভ কথার প্যাঁচমারা শুরু করি, কিছুক্ষণ পরে আমাকে বলে “তুমি রাজনীতিবিদদের মত ধরি মাছ না ছুঁই পানির মত কথা বলতেছো কেন?? রাজনীতি কর নাকি??” । শালার রেদোয়ান বলে উঠে “রাজনীতি মানে সেই মাপের রাজনীতি, (_____) আর (_____), দুই বিশেষ ব্যক্তি নাকি আমার কাছ থেকে রাজনীতি শিখে যায়।” দ্যাট ওয়াজ সো ফানি, মজা পাইছিলাম।

দুপুর থেকে না খাওয়া থাকার কারণে পেটের ভিতরে আগুন লেগে যায় আমার রাত ৮ টা বাজার সাথে সাথেই (আমার ভুঁড়ি একটু বড় কিনা )। কোনরকমে ৮:৩০ বাজার অপেক্ষা করে আমাদের ডাইনিং (খাবার খাওয়ার নির্দিষ্ট স্থানে) উপস্থিত হই আমি। কিন্তু একি!!

ভূত ভূত ভূত !!!!!!

গিয়ে দেখি টার্কের মোটামুটি সব মানুষ হাজির হয়ে আছে সেখানে। গেটের বাহিরে (গেট কিন্তু বন্ধ না,শুধু ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে কিন্তু ভিতরে ঢুকার অনুমতি নেই ) দাঁড়িয়ে আছে। ঐখানের ১০টা মিনিট চিরদিন মনে থাকবে। শাহবাগ আন্দোলন যে কতটা সাহায্য করেছে আমাদের এই ছাত্র সমাজকে তা উপলব্ধি করলাম আমি সেখানে ।

গেট খুলছে না দেখে স্লোগান চলছে, কে স্লোগান দিচ্ছে কেউ জানেনা কোথায় স্লোগান দিচ্ছে তাও জানে না, সামনে পিছে সব যায়গা থেকে শ্লোগান আসছে। সবাই তাতে একত্ততা পোষন করচ্ছে। নিচে কিছু নমুনা দেয়া হল –


আমরা সবাই ভাত চাই,

তাড়াতাড়ি ভাত দে ।



ভাংগোরে ভাংগো,

দরজা ভাংগো ।



এই বারের সংগ্রাম,

ভাত খাওয়ার সংগ্রাম ।



ছিনায়ে নিমু, ছিনায়ে নিমু

ভাত আইজকা ছিনায়ে নিমু ।



গরু চাই না, মুরগী চাই না

ভাত চাই, ভাত চাই ।


তাড়াতাড়ি দরজা খোলো,

ভাত খাব, ভাত খাব ।


(আরও অনেক স্লোগান ছিল, সব মনে পড়ছে না)


যথাসময়ে দরজা খুলে আমাদের অবস্থা দেখে ডাইনিং এর ভাইয়েরা হেসে দেয়, আমরাও হেসে ফেলি। ভাত নয়, টার্ক যাত্রা শুরু হয় পোলাও দিয়ে ।

বাছুরের লাগাম ছুটে গেলে তাকে যেমন ধরা যায় না, তেমনি সারা জীবন শহরের উঁচা উঁচা বিল্ডিংয়ে আর ঘরের মাঝে কিংবা ছাদে ক্রিকেট খেলে অভ্যস্থ তাদের অবস্থা এই বাছুরদের মত। ফাঁকা মাঠ, বাবা-মা না থাকার কারণে উন্মুক্ত স্বাধীনতা, বলার কেউ নাই, এই সকল কারণে তাদের আনন্দ দেখে আমি বরাবরই হাসি। একটা বিশেষ প্রজাতি সম্পর্কে বলতে ইচ্ছে করছে না, তারা অলওয়েজ ফার্স্ট (বুইঝা লন মিয়া)।

তবে এই বাছুর সম্প্রদায়কে দেখে আমারও খুবই ভাল লাগে, তারা আছে বলেই এইখানে বেঁচে থাকার আনন্দ পায়, পায় প্রানোচ্ছ্বাস। তাদের আনন্দ দেখতে পাচ্ছি বলেই জীবনের আনন্দ উপভোগ করতে পাচ্ছি। লাভ ইউ গাইজ (ভালোবাসি তোমাদের)। আমাদের আবার ইংরেজি বলতে হবে ডোর্মের বাহিরে। অনলাইন তো ডোর্মের বাহিরেই নাকি মিয়া ভাই-বইনেরা???


এই লিখাটি আমার ভালোবাসার মানুষগুলি এই ছুটে যাওয়া লাগামহীন বাছুরগুলির জন্যে। তাদেরই উৎসর্গ করলাম।

(চলবে)

এই লিখাটা মজা করে লিখা, আমার জীবনকাহিনী আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি তাই এই লিখার সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। আমার রেফারেন্স দিয়েও কোথাও প্রকাশ একদম নিষেধ। এই লিখাটি একান্ত আমার ব্যক্তিগত জীবন কাহিনি, আপনার অভিমত আপনি প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু কোন প্রকার সমালোচনা সহ্য করা হবে না। লিখাটির লিঙ্ক আপনি চাইলে শেয়ার দিতে পারেন।

হুমায়ুন তোরাব

মে ১৭,২০১৪

আশুলিয়া, সাভার,

ঢাকা

Powered by Froala Editor