জীবন-কথন

RS -36 (TARC) জীবনের পাতা থেকে : রোদের মাঝে এক পশলা বৃষ্টি ।

Jun 04, 2014

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রত্যেক ছাত্রকে তাঁর চার বছরের গ্র্যাজুয়েশন জীবনের ৩টি মাস (ব্র্যাকের হিসেবে একটি সেমিস্টার) সাভারে অবস্থিত ব্র্যাকের ক্যাম্পাসে থাকতে হয়। পূর্বে এই জায়গাটিতে শিক্ষকদের ট্রেইনিং দেয়া হলেও বর্তমানে এখানে ছাত্রদের ট্রেইনিং দেয়া হয়। এই তিন মাস সময়কে আগে TARC বলা হলেও বর্তমানে RS বলা হয়ে থাকে । আমার জীবনে টার্কে থাকা সময়কে নিয়েই আজকের RS -36 (TARC) জীবনের পাতা থেকে এর দ্বিতীয় পর্ব রোদের মাঝে এক পশলা বৃষ্টি ।


মানুষ বড়ই আজব জীব ,এদের নিয়ম গুলিও বড় অদ্ভুত । এই মানুষের দুনিয়াতে কেউ অন্যায় করে জেলে প্রবেশ করে আর ব্র্যাকের ছাত্র হলে তারা বিশাল অংকের টাকা দিয়ে জেলে প্রবেশ করে ।

হুম আমি টার্কের কথায় বলছি ।

টার্ক,একটি জেল খানা ।

টার্ক সম্পর্কে লিখতে গেলে প্রিজন ব্রেকের কথা না বললেই নয় । আপনারা যারা সিরিয়াল টা দেখে থাকবেন অথবা যাদের কারাগারে থাকার অভ্যাস আছে তারা জেনে থাকবেন জেলে অথবা কারাগার যায় বলুন না কেন সেখানে প্রথম যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তা হল সিগারেট । জেলের ভিতরে কোন সিগারেট পাওয়া যায় না । সে হিসেবে টার্ক একটা মজার জায়গা,এর ভিতরে সিগারেট পাওয়া না গেলেও লাইটার পাওয়া যায় । আরও মজার ব্যাপার হল এইখানে স্মোকিং জোন আছে । প্রতিটা ডোর্মে ডোর্মে রয়েছে স্মোকিং জোন । যারা সিগারেট খাই তাদের এই ছোট্ট কয়েদ খানাতে সিগারেট খেতে হয় । এখানে এসে সিগারেট খোর দের সিগারেট খাওয়া দ্বিগুন কিংবা তিন গুন হয়ে গেছে । সিগারেট যেহেতু পাওয়া যায় না তাই সিগারেট স্টক করে রাখতে হয় এক সপ্তাহের জন্যে । শুধু শুক্রবার এক বার বের হওয়ার সুযোগ পায় সবাই নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্যে । পোলাপাইন নামাজ পড়তে না সিগারেট কিনতে শুক্রবারে বাহিরে যায় তা অবশ্যয় চিন্তার বিষয় । :((:((:((:((:((:((:((:((:((

এইটা স্যারদের অনমুতি ক্রমে সিগারেট কেনার উপায় ,সমস্যা হল এইখানকার সিগারেট প্রত্যেকটায় ডুপ্লিকেট । এই সমস্যা সমাধানের জন্যে কয়েকজন সিগারেট আবিষ্কার করে আরেকটা ঘুষিয়ও পদ্ধতি । টার্কের একটা মাঠের(দূর্বার) ভিতরে বাস্কেট বল খেলার কোর্ট বানানো হচ্ছে ,সেখানে কাজ করা মামাদের কিছু বকশিস দেয়ার মাধ্যমে আসল সিগারেট আনিয়ে নেয়ার পদ্ধতি বের করে তাঁরা । প্রথম সপ্তাহ একটু কষ্ট করে এভাবে পার হয়, প্যারেণ্টস ডে পার হওয়ার পরে প্যাকেট ভর্তি ভর্তি সিগারেটের মজুদ দেখে ভালই লাগে । কোথা থেকে এত প্যাকেট সিগারেট আসলো তা আসলেই বুঝা মুশকিল ।

৩৩ একর জায়গার উপরে এই টার্কে একটা দোকান আছে । তবে আপনি ঢাকা থেকে এখানে আসার পরে আপনার মেজাজ খুবি খারাপ হয়ে যাবে কারন আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন আপনার যা যা দরকার তার কোনটায় এই দোকানে নেই । মিনিট খানেক যাওয়ার পরে যখন আপনি বুঝতে পারবেন দুই হাজার টাকা দিলে এই দোকানের সব কিছু আপনি কিনে ফেলতে পারবেন তখন আপনার ঠোঁটে একটা হাসির আভা(শব্দ টা মনে রাখবেন,আমার সামনের লিখাগুলিতে শব্দটা অনেকবার আসবে :D) । আমার প্রথম দিকের বিরক্তকর টার্ক লাইফ আনন্দদায়ক করে তুলতে এই শব্দ টার অবদান আছে ।

টার্কের প্রধান উদ্দেশ্য কি আমি জানি না । আমি ঠিক বুঝতে পারছি না । তবে টার্কে এসে আমাদের মত ছাত্রদের জীবন সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানার সুযোগ হয়েছে । টার্কের সবচেয়ে বড় মজার ব্যপার হল লাগামহীন বাঙ্গালীদের একটা নিয়ম তান্ত্রিক জীবনের মধ্যে বেধে ফেলা ।

রুটিং জীবনের কিছু বর্ননা -

সকাল ৭.৩০ টা থেকে সাড়ে ৮.৩০ টার মদ্ধ্যে কেউ ঘুমিয়ে থাকল ,ওকে দ্যাটস ফাইন ,তোমাকে সকালের খাবার খেতে হবে না,এইটা ব্রেকফাস্ট টাইম । সকাল ৮.৪৫ এ জাতীয় সঙ্গিত গাইতে হবে । প্রথম কয়েকদিন ভুল জাতীয় সংগীত গাওয়া হলেও আমি কয়েকবার স্যারদের কাছে অভিযোগ দেয়া তে শুদ্ধ করা হয়েছে । সবার ধারনা “আমার সোনার বাংলা ” মানেই জাতীয় সংগীত কিন্তু তাঁর যে কিছু নিয়ম কানুন আছে তা কেউ খেয়াল করে না । জাতীয় সঙ্গী প্রত্যেক দিন গাওয়ার জন্যে বাংলাদেশ স্টাডিজের ২ নম্বর আছে । ৯০ নম্বরে যেখানে A দেয়া হয় সেখানে ২ নম্বর অনেক কিছু । কি আপনি গাইবেন না ??

স্কুল লাইফের মত লাইনে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মজায় আলাদা ।

আমার মনে হয় এই কয়েকটা কারনই যথেষ্ট কাওকে সকালে ঘুম থেকে তোলার জন্যে । ঠিক না ??

আরও মজার ব্যপার হল ক্লাসে উপস্থিত না হওয়ার প্যরা । কেউ ক্লাসে নাই । সাথে সাথে ফোন ,ফোনে না পেলে হোস্টেল টিউটর তাকে খুজতে বের হবে । তাঁকে খুজে খুজে ক্লাসে পাঁঠানো হবে । কেউ ঘুমিয়ে থাকলে তাকে ঘুম থেকে তুলে পাঠানো হয়ে থাকে । প্যারা রে মাম্মা ,সেই প্যারা ।

দুপুর ১২ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত দুপুরে খাওয়ার সময় । রাতের খাওয়ার সময় সাড়ে ৮ টা থেকে সাড়ে ৯ টা । রাতের খাবারের জন্যে আমাদের প্রত্যেকদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ।

তাছাড়াও সারাদিনে দুইটা টি ব্রেক আছে,একটা সকাল সাড়ে ১০ টায় আরেকটা বিকাল ৪ টায় ।

খাবার হিশেবে সকালে রুটি,পাওরুটি,পরাটা থাকে । দুপুরে এবং রাতে মুরগী ,গরু,খাসি । মজার ব্যপার হল মুরগী,গরু ,মাছ এবং খাসি সবই ব্র্যাক মুরগী, ব্র্যাক খাসি , ব্র্যাক মাছ এবং ব্র্যাক গরু । মানে এই গুলি সবই ব্র্যাকের নিজেস্ব ফার্ম থেকে আনা হয়ে থাকে ।

আর নিয়ম শৃঙ্খলা কথা বলা সম্ভব না ,নিয়ম শৃঙ্খলার কথা চিন্তা করলে টার্কে কিছু করার নাই । তাই আমার পরে যারা আসবে তাদের একটায় উপদেশ তোমাদের যা ইচ্ছা কর কোন সমস্যা নেই । অত নিয়ম ফিয়ম মনে রাখার কোন মানে নাই । যাস্ট একটা ভিন্ন লিঙ্গের মানুষের সাথে একটু সাবধানে ...............।।

অনেক দিন আকাশে মেঘের দেখা দিলেও বৃষ্টির দেখা একদমই দিচ্ছিল না টার্কে । আমরা এক বেলা ভেজার জন্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আমরা ৪৫২ জন ছাত্রছাত্রী । কিন্তু নাহ,কেন যেন বৃষ্টি হচ্ছিল না । আশ্চর্যের ব্যপার হল আমার রুম তৃতীয় তলায় পড়াতে খুবই ভাল বাতাস পেতাম । আমাদের ড্রোম একদম এক কোর্নারে হওয়ার কারনে আমাদের আশে পাশে কোন বিল্ডিং অথবা ছোট কুড়ে ঘরও ছিল না ,যতদুর চোখ যায় জঙ্গল আর জঙ্গল । রাতের বেলা আমরা শিয়ালের ডাক শুনতে পাই ।

তবুও বৃষ্টির মাঝে ভেজার আক্ষেপ ছিল । সব বন্ধুরা মিলে বৃষ্টিতে ভিজব । প্রত্যেক দিনই আকাশে মেঘ উঠে কিন্তু বৃষ্টি নামে না,আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি । টার্কের দুরন্ত দুর্বারে শুয়ে থাকি রাত ১০ টা পর্যন্ত ,একটু বৃষ্টিতে ভেজার আশায় ।

অবশেষে বৃষ্টি নামে ,টার্কের ভুমিতে বৃষ্টির ছোটা পড়ে ,আনন্দে নেচে উঠে ৪৫২ টি প্রাণ । মেতে উঠি কাঁদা কাঁদা খেলায়,যাকেই দেখছিলাম তাকেই ধরে এনে কাঁদাতে গড়াগড়ি করাচ্ছিলাম । কিছুক্ষনের জন্যে কাঁদা মানব হয়ে পড়েছিলাম আমরা ,মুখের ভিতরে কত গুলি কাঁদা পানি ঢুকেছে তাঁর কোন ইয়ত্তা নেই । অনেক গুলি কাঁদা মানব দুর্বারে দাঁড়িয়ে ছিলাম । আরেকটা কথা কাঁদাতে আমরা ছেলেরাই কেবল মাখামাখি করেছি,মেয়েরা না ।

টার্কের নাম শুনলেই কিছু মানুষের প্রশ্ন শুরু হয়ে যায় ,তাঁরা NGO ব্র্যাক আর ব্র্যাক উইনিভার্সিটিকে এক করে ফেলে, ব্র্যাক উইনিভার্সিটি ব্র্যাক দ্বারা পরিচালিত হলেও আমাদের স্বকীয়তা আছে ।

আজ টার্কে আমার ১৭ তম দিন ,একটি একটি দিন যাচ্ছে আর ভাবছি ইশ জীবন থেকে এক টুকরা স্বর্ণের সময় হারাচ্ছি । এই কয়েকটা দিনের কথা মনে করে সারা জীবন কাঁদতে হবে আমাকে এই কথা আমি নির্দ্বিধায় লিখতে পারি ।

(চলবে)

আমার জীবন কাহিনী আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি তাই এই লিখার সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । আমার রেফেরেন্স দিয়েও কোথাও প্রকাশ একদম নিষেধ । এই লিখাটি একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত,আপনার অভিমত আপনি প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু কোন প্রকার সমালোচনা সহ্য করা হবে না । লিখাটির লিঙ্ক আপনি চাইলে শেয়ার দিতে পারেন ।।

Powered by Froala Editor