এই গল্পের শুরু হয়েছিল আজ থেকে আড়ায় বছর আগে । ২০১৪ সালের মে মাসে । ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সময়ই ভাইবা নেওয়ার সময় আমাকে ফ্যাকাল্টি প্রশ্ন করেছিল - তুমি টার্ক সম্পর্কে কি জান ? টার্কে যেতে তোমার কোন সমস্যা নেই তো ? ভার্সিটি ভার্সিটি ঘুরে চান্স না পাওয়া আমার মত মানুষের জন্যে তখন চান্স পাওয়াটায় বেঁচে থাকার একটি শিকড় হয়েছিল । সে যায়হক, এই প্রশ্নের জন্যে আমি তৈরি ছিলাম এবং জিজ্ঞেস করা মাত্রই উত্তর দিয়ে টিকে গেলাম,ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ।
অতঃপর দেখতে দেখতেই কেটে গেল চার মাস । বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানালো হল সাভারে যেতে হবে । সেমিস্টার ফি'র সাথে ৮৬ দিনের থাকা খাওয়ার জন্যে যখন অতিরিক্ত ৪০ হাজার টাকা দিচ্ছিলাম ,সেই দুঃখের কথা আর না বা বললাম । এখন সেই টাকার পরিমান সম্ভবত ৫৫ হাজার ।
দেখতে দেখতে ১৬ই মে ২০১৪ এসে গেল এবং বিকেল গড়তেই বাসে উঠে গেলাম । আড়ং এর বাস যখন এয়ারপোর্ট হয়ে সাভার যাচ্ছিল তখন রাস্তার পাশে আমার স্কুল,প্রত্যেকদিনের আড্ডা দেওয়ার স্থান দেখতে ছিলাম আর ভাবছিলাম তিনমাস,তিনমাস এই সব কিছু থেকে দূরে থাকতে হবে । নিকোটিনের শলাকাতে উড়িয়ে দিচ্ছিলাম বুকে জমে থাকা হাহাকারগুলি । বেশ কষ্টয় লাগতেছিল ।
পাশে বসে থাকা আমার ব্র্যাক জীবনের তখনকার একমাত্র বন্ধু রেদোয়ান । তাকে দেখাচ্ছিলাম ,এই যে এইখানে আমি চা খাই,এই খানে আড্ডা দেয় । এইখানে ট্রেনের নিচে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছি । আর এইখানে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম একবার ।
বহু পথ ঘুরে,ভাঙাচুরা রাস্তায় হেলে দুলে অবশেষে পৌছে যায় আশুলিয়ার ব্র্যাক ক্যাম্পাসে । যখন গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে ছিলাম তখনও বেশ উত্তেজিত ছিলাম ,টার্কে আসছি ভাবই আলাদা । অনেক কিছু করব,অনেক আনন্দ করবো ,পুরাই কুল জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ১৭ একরের বদ্ধ কারাগারে প্রবেশের সময় ঠিকমত বুঝতে পারিনি ,গল্পের আরেক পিঠ,অন্যরকমও হতে পারে । টার্কে যেয়ে প্রেমটেম করারও অবশ্য ইচ্ছে ছিল,কপালে নাই তাই হয় নাই ,এই দুঃখে এই বুড়ো বয়সেও চিরকুমার হয়ে আছি । আমার কিঞ্চিত ধারনা মেয়েরা আমাকে পছন্দ করে না,অবশ্য পছন্দ করা কিংবা না করাতে আমার মত গরু কিংবা ছাগলের কিছু আসে যায় না ।
টার্ক নিয়ে এবং টার্কে গড়ে উঠেছে অনেক সম্পর্ক অনেক স্মৃতি গল্প । আমি অস্বীকার করছি না যে তুষার ভাইয়ার অসাধারন কথাতে এই টার্কেই সৃষ্টি হয়েছে মিফতা জামান ভাইয়ার অসাধারণ অমর সংগীত "চির অধরা" কিংবা এই টার্কেই রচিত হয়েছে অনেক বন্ধুত্বের ,এবং এই বন্ধুত্বই একসময় বন্ধুত্বের সীমা ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে জীবনের সাথে জীবনে । প্রজন্ম থেকে প্রজন্মেও হয়তো একদিন ছড়াবে ।
টার্ক নিয়ে লিখা গল্প, কবিতা কিংবা ব্লগের অভাব নেয় এই অন্তঃজাল জুড়ে । আমার মত প্রখ্যাত টার্ক হেটারের হাত দিয়েই বেরিয়েছে টার্ক নিয়ে তিনটা সুবিশাল ব্লা ব্লা লিখা সাথে কয়েকশ স্ট্যাটাস । টার্ক ব্র্যাক ছাত্র-ছাত্রীদের খুবই স্পর্শকাতর ,ভালবাসা এবং আবেগের যায়গা । ব্র্যাকের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরা গালি খেতেও রাজি আছে কিন্তু তারা টার্ক নিয়ে কোন সমালোচনা শুনতে রাজি নয় ।
আমি ছোট বেলা থেকেই ঘুরাঘুরি করে বেড়ানো মানুষ । দিনেরবেলা বাসা থেকে বের না হলে নিজের মনে স্বস্তি আসে না,তাই জ্বর থাকলেও জ্বরের তাপ কমলে একটু বাহির থেকে বাতাস খেয়ে আসি । স্পষ্ট মনে আছে ,আমার যখন "বসন্ত" রোগে ছেয়ে গিয়েছিল সমস্ত শরীর তখন বের হতে পারতাম না বলে ছাদে গিয়ে বসে থাকতাম । টার্কের গেট দিয়ে প্রবেশের সময় ,যখন দিগন্ত ডর্মের(এখন সম্ভবত আর নেই) সামনে দিয়ে প্রবেশ করতেছিলাম, তখনও বুঝতে পারিনি, জীবনের এমন একটা ধোঁয়াটে একটা অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছি ,যার কথা কাওকে বলতেও পারবো না কিংবা বলে বুঝাতেও পারবো নাহ ।
যায়হক, এক শুক্রবারে বিকালে শেষ বাসে করে টার্কে প্রবেশ করি । অল্প কিছু মানুষ ছাড়া সবাই নতুন মানুষ । মাঠে ঢাকা শহরের চার দেওয়ালে আটকে থাকা মানুষগুলির দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে,বেশ ভালই লাগতেছিল । আমার টার্কের শ্রেষ্ঠ সময় সম্ভবত কেটেছে প্রথমদিনে রাতে দুরুন্তে(টার্কের মাঠ) আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকা,পাশে অবশ্য রেদোয়ান বসে আছিল । ঘাসের উপর শুয়ে রাতের আকাশের অসংখ্য তারা দেখার সৌভাগ্য সেদিনই প্রথম হয়েছিল ।
Powered by Froala Editor