গল্প

ইটস লুতুপুটুস প্রেম স্টোরি

Dec 28, 2016

পশ্চিমের লাল সূর্য টুপ করে ডুবে যাওয়ার জন্য ক্ষন গুনছে । দক্ষিণ দিক হতে মাঝে মাঝে আশুলিয়ার খালের উপর থেকে বাতাস আসছে । রাজ্যহীন রাজার যেমন ক্ষমতা থাকে না পিপড়া মারার, তেমনি ডুবন্ত লাল সূর্যের আলোরও ক্ষমতা থাকে না মানুষের চামড়া পোড়াবার। সূর্যের সেই মিহি আলোতে মিম্মি বসে আছে বারান্দার গ্রিল ধরে। মাঝে মাঝে দক্ষিণা হাওয়ায় তার চুল উড়ছে। মিষ্টি চুমু মাখা রোদেলা স্পর্শ তার গায়ে লাগছে । সোনালী রোদে মিম্মির হাতের লোমগুলো চকচক করছে । আশুলিয়া খালের দু'পাশে কাশফুল ফুটেছে । শহর থেকে বাহিরে কিছুটা নির্জীব এলাকাতেই মিম্মিরা থাকে । মাস দুয়েক আগে তাহমিদ তৃতীয় তলার এই ফ্ল্যাট টা কিনেছে । জায়গাটা বেশ সুন্দর । ১০ তলা বাড়ীর ছাদ হতে তাকালে বেশ ফাকা ফাকা লাগে। যতদুর চোখ যায় কেবল মানুষ দেখা যায় । ঢাকা শহরের মানুষ রুপী রোবট থেকে এইসব মানুষগুলোকে দেখা পরম সৌভাগ্যের ব্যপার। মিম্মির তৃতীয় তলা থেকে খালটা দেখা যায় । স্কুল-কলেজের ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের যুগলে পরিপুর্ণ থাকে সকালে। দুপুর হতে হতে খাঁ খাঁ করে। বিকেলে কিছু মানুষকে দেখা যায় খালের ধারে হাটতে কিংবা সময় কাটাতে । মিম্মির মস্ত বড় শরীর নিয়ে চলতে বেশ কষ্ট হয়। এইতো, আর দশ-পনেরো দিন। নতুন মানুষ আসবে। পেটের উপর হাত বুলাতেই ভাল লাগল মিম্মির । তিয়ারা আসছে । খুব তাড়াতাড়িই চলে আসছে ।


বাড়ী ভর্তি মানুষ । মিম্মির আব্বু-আম্মু চলে এসেছে পাবনা থেকে, তাহমিদের আব্বু-আম্মু তো আছেই । সবাই মিলে বাড়ীটাকে মাথায় তুলে রেখেছে। একমাত্র ছেলের প্রথম সন্তান আসছে । আনন্দে আত্মহারা মিম্মির শশুর-শাশুড়ি । তাহমিদের দুলাভাই জয় আজ আসবে বাসায় । গত এক মাস ধরে তাহমিদের বড় বোন তাসনিয়ার জ্বালায় প্রায় বিরক্ত হয়ে উঠেছে মিম্মি । এত নিষেধ কি মানা যায়? একটা কাজও করতে দিচ্ছেনা তাকে তাসনিয়া । মিম্মি ভাবছে জয় ভাইয়া আসলে আচ্ছামত বকে দিতে বলবে সে।

ভাবতে ভাবতে সূর্য টুপ করে কখন জানি ডুবে গেল। চারিদিকে আন্ধকার ধেয়ে আসলো । শরতের দক্ষিণা বাতাস হু হু করে বইছে । তাসনিয়া এককাপ চা নিয়ে এলো মিম্মির জন্য । চা খেতে খেতে রাতের গল্প আরম্ভ করল তারা। রাতের প্রথম প্রহরের গল্প।

তাহমিদও বেশ বদলে গেছে। আগে সন্ধায় অফিস থেকে ফিরে বন্ধুদের সাথে গল্প-গুজব করে বাড়ি ফিরত। এখন সন্ধা হতেই বাড়ি ফিরে আসে। যতটা সময় পারে মিম্মির সাথে কাটায়। তিয়ারার দাদাও বেশ হৈ-হুল্লোর করছে । কোথা হতে একটা দোলনা এনেছে, তিয়ারাকে এখানে দুলতে হবে । তাহমিদও নাকি এই দোলনায় শুয়ে বড় হয়েছে। মনে মনে বিরক্ত হয় মিম্মি। এই সময়ে দোলনা, পুরনো কালচার। তবুও তাদের কিছু বলেনা সে । তাদের বৃদ্ধ বয়সের এই ছেলেমানুষি ভালই লাগে মিম্মির। তিয়ারার নানু-দাদীও বাদ যায় না। তারা ছোট ছোট জামা কাপড় তৈরি শুরু করেছে । তাদের বানানো কাপর ছাড়া অন্য কাপর তিয়ারা নাকি পরতে পারবে না । ধুর, এটা আবার কেমন কথা? বাজারে কত সুন্দর সুন্দর কাপড় । লাল, নীল, বেগুনী, আকাশী!! মনে মনে রাগ করে মিম্মি। তার মেয়ের উপর যেন তার কোন অধিকার নেই, যে যার মত প্ল্যান করছে। তবে বোধহয় তাতে একটু খুশিও হয় সে। ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি দেখা যায় তার ।

মিম্মির বড় ভাই অনিক আমেরিকা হতে আজ রওনা দিয়েছে । পরশু দিন বাংলাদেশে আসবে । তার সাথে ভাবিও আসছে। ছোট বোনের প্রথম সন্তান আসছে, কিভাবে থাকে নিউইয়র্কে ?

দেখতে দেখতে কতগুলো বছর কেটে গেছে ভাবতে থাকলো মিম্মি । সেই কলেজ জীবনে ফেসবুকে ঠুকাঠুকির পর প্রেম। তারপর ফার্মগেট, শাহবাগ, নীলক্ষেতে উড়ে বেড়ানো । ৩ টাকার এক পিস ডালপুরি, ঝালমুড়ি কিংবা ছোট ছোট দোকানের চা । KFC, BFC, Westing কিংবা ফুটপাতের হাওয়াই মিঠাই । সব যায়গার স্বাদ লেগে গেছে তার মুখে। মাঝে মাঝে লালার মাঝেও পুরোনো দিনের স্বাদ পায় মিম্মি। গত ৭ বছরে সব পাল্টে গেছে। চেনা মানুষ গুলো হারিয়ে গেছে, কেউবা চলে গেছে জীবনের ডাকে। শুধু আছে জীবন। ঘর সংসার।

সন্ধার আকাশে বড় হয়ে চাঁদ উঠেছে। বারান্দার রকিং চেয়ারে তখনও দোল খাচ্ছে মিম্মি। হাত তার সন্তানের মাথার উপরে । সন্তানের পরম নির্ভরতার হাত। ভালোবাসার নাড়ী ছিড়া রক্ত মাখা হাত।

এক সপ্তাহ পরে।

তাহমিদের গাড়ি ছুটছে। পেটে ব্যথা উঠাতে হাসপাতালে মিম্মি। অফিসের কাজে একটু বাইরে এসেছিল তাহমিদ। জানার পর পরই গাড়ি ছুটাতে আরম্ভ করেছে সে। ৮০ কিমি/ ঘন্টা চললেও তার মনে হচ্ছে গাড়ি থেমে আছে স্তব্ধ হয়ে। অন্যদিকে মিম্মির অপারেশন চলছে । এসির বাতাসেও ঘামছে তাহমিদ। কয়েকবার দৈবচয়নে এক্সিডেন্টের হাত থেকে বেঁচে গেছে সে। আশুলিয়া ঢুকার পথে ফোন এল মিম্মির বড়ভাই এর কাছ থেকে।

ফোন ধরতেই ভেসে এল একটি বাচ্চার কান্না।

মেয়েটির নাম যে তিয়ারা, তা বুঝতে সময় লাগল না তাহমিদের। শুধু এতটুকুই বলল সে।

আলহামদুলিল্লাহ্।

তখনো আকাশে সূর্যের ত্রিব্র আলো দেখা যাচ্ছিল । ক্লান্তি ভাবে বছরের পর বছর আলো দিয়ে যাচ্ছে ।মাঝে মাঝে মেঘের আকাশে ছুটি নেয় । দিন এভাবেই চলছে রাতের আধারে চাঁদ উঠছে । নানা যোগবিয়োগের মাঝে নানা যন্ত্রণা সংশয়ের মাঝে । ছলছে জিবন,চলুক না আরেকটু । আর আমাদের এখানে প্রয়োজন নেই। তুমি মরে গেছ। আমিও বোধহয় মরে যাচ্ছি। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। জীবন ধারাবাহিক। জীবনের মৃত্যু নেই।


Powered by Froala Editor